জয়িতার গানের যাত্রা
- Joyeta Moietree
- Jul 19, 2021
- 3 min read
ছোটবেলা থেকেই মাকে অনেক গান শুনতে দেখতাম আমি। রাতে মা একটার পর একটা নানা ধরনের গান শুনতো আর গুনগুন করে গাইতো। পড়াশুনার চাপ আমার তখন ছিল না বললেই চলে। তাই সন্ধ্যার পর থেকে মার সাথেই আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো গান শুনে শুনে। একধরনের অভ্যস্ততার এই শৈশব আমার কাছে কখনো একঘেয়ে মনে হয়নি। বরং এখন মনে হয় খুব দ্রুতই চলে গেছে আমার আকাঙ্ক্ষিত শৈশবের সেই সন্ধ্যাগুলো।
যাই হোক, সেইসব সন্ধ্যায় গান শুনতে শুনতে মা প্রায়ই আামাকে বলতো "তুই বড় হয়ে গান শিখবি। রাতে বারান্দায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত আমি তোর গান শুনবো।" গান আর আমার কাছে মার গান শুনতে চাওয়া - এই দুটো শুনে শুনেই একসময় আমার শৈশব পার হয়ে যায়।
কেনো জানি আমার আর গান শেখা হয়ে উঠেনি। তবে মার এইরকম অগনিত গান শোনার কারণেই মার গানের প্রতি যেই আগ্রহ এবং ভালবাসা দুটোই ছোটবেলা থেকে আমার মধ্যে ছিল। যদিও না শেখার কারনে অন্যকে গান শোনাতে আমার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা তখনো ছিল, এখনো আছে।
তবে নতুন-পুরোনো গান শোনার প্রতি যে ধরনের আগ্রহ আামার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল, সেটার মধ্যে গান শোনার ইচ্ছা নাকি অন্যকে শোনানোর ইচ্ছা, নাকি দুটোই, কোনটা যে প্রবলভাবে কাজ করতো সেটা আর এখন বলতে পারবো না। তবে, আমার কাছে মার গান শুনতে চাওয়াটা যে আমার মনের মধ্যে সবসময়ই ছিল, সেটা বেশ ভালো ভাবেই টের পেতাম।
তাই ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকে পছন্দের সব গান শুনে শুনে শিখে মাকে গেয়ে শোনানো শুরু করলাম। মজার ব্যাপার হলো, মার আর আমার গানের পছন্দ কাকতালীয় ভাবে মিলেও যেতো। যখন আমি গান গাইতাম, দেখতাম মা মুগ্ধ হয়ে আমার গান শুনছে। মার এই মুগ্ধতা আামাকে কি যে এক অপার্থিব আনন্দ দিতো! মনে হতো এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আামি যে ভালো গাইতাম তা না, এখনো যে ভালো গাই তাও না। তবে আমাার গান শুনে মার এই মুগ্ধতা আমাকে আরও গান গাইতে উৎসাহিত করতো।
তবে এই উৎসাহে মাকে আরও নতুন নতুন গান গেয়ে শোনালেও অন্যদের সামনে গান গাইতে বরাবরই সংকুচিত লাগতো আমার। কিন্তু আমাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর ব্যাপারে মার উৎসাহের সীমা ছিলনা।
আমার গাওয়া গানগুলো মাঝে মাঝেই মা রেকর্ড করে ফেসবুকে আপলোড করতে শুরু করলো। সেখানে মার অনেক পরিচিত বন্ধুদের কমেন্ট আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করতো। এমন হয়েছে হয়তো মার সাথে তার কোনো ফ্রেন্ডসার্কেলের প্রোগ্রামে গিয়েছি, সেখানে মা আামাকে গাইতে বলতো আর অস্বস্তি হলেও তখন আমাকে গাইতে হতো। সেখানে খুব একটা ভালো না গাইলেও মার বন্ধুরা বেশ প্রশংসা করতো আামার গানের।
আর এই সব ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে আমাকে নিজের গানের ব্যাপারে খানিকটা আত্নবিশ্বাসী করে তুললো।
গত বছর কোভিড-১৯ লকডাউনের শুরুর দিকে যখন ক্লাস নাইনে উঠেছি, তখন স্কুলের এক প্রেজেন্টেশনের জন্য আমাকে একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলতে হয়। খুব শীঘ্রই প্রেজেন্টেশনের কাজ শেষ হয়ে যায় কিন্তু চ্যানেলটিকে নিয়ে আমার মনে একটি ভিন্ন ভাবনা আসে।
ততদিনে অনেকের সামনে গান গেয়ে একটু একটু সাহসী হয়ে উঠেছি। তাই কি মনে করে, নিজের কিছু গানের কাভার সাহস করে চ্যানেলে আপলোড করেই ফেললাম! আমার ছোট্ট চ্যানেলের তুলনায় গানগুলো বেশ ভালোই ভিউ পেলো। পরিচিত অনেকেই প্রশংসা করে কমেন্ট করলো আর এতে আামি আরও উৎসাহিত হলাম।
এর মধ্যেই এক বছর চলে গেছে। ইউটিউবে আরও নানা কাজ করেছি আমি, এখনো করছি। গান আপলোড করাও থেমে নেই।
তবে এখন যখন গান গাই, সেটা হয় কেবলই রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করার জন্য, মাকে শোনানোর জন্য না।
এখন মাঝে মাঝেই একধরনের শূন্যতা অনুভব করি মনের ভিতর। মনে হয় মাকে গান শুনিয়ে আমার আনন্দের যে তীব্রতা ছিল তা কোথায় যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
আমি ভীষণ মিস করি সেই জয়িতাকে যার এতো ভিউ বা অন্যদের প্রশংসা, কোনটারই স্বপ্ন ছিলনা। ছিল শুধু মাকে মুগ্ধ করার স্বপ্ন, মার ইচ্ছা পূরণ করার স্বপ্ন, ভালোবেসে গান গেয়ে মাকে খুশি করার স্বপ্ন।
সময়ের সাথে সাথে মা কিন্তু বদলায়নি, বদলেছি আমি। মা এখনো আগের মতো মুগ্ধ হয়ে আমার গান শুনে। মা এখনো আমার সাথে প্রতি সন্ধ্যায় গান শুনতে চায়। মা চায় আমি প্রতি রাতে মাকে একটার পর একটা গান গেয়ে শোনাই, ঠিক আগের মতো। কিন্তু, আমার আনন্দের পরিমাপক এখন মার মুগ্ধতার বদলে হয়ে গেছে সামান্য কিছু সংখ্যা - সামান্য কিছু ভিউ, লাইক, ডিজলাইক, আর কমেন্টের সংখ্যা।
আমার খুব অবাক লাগে যখন দেখি আমার এই বদলে মার আমার উপর কোনো অভিমান নাই। নাই কোনো অভিযোগও। এমনকি এখন আর আগের মতো মাকে গান শোনাইনা বলে আমার সাথে কখনো মন খারাপ করতেও দেখিনি মাকে। মার মুগ্ধতা হোক কিংবা ভিউয়ের সংখ্যা, আমি আনন্দে আছি এটা দেখেই মা খুশি।
আমি আমার ইউটিউব শ্রোতাদের কাছে সত্যি খুব কৃতজ্ঞ। ইউটিউবের কারণেই আমি আজ অনেক নতুন ধরনের কাজ করতে পারছি, নতুন ভাবে নিজের ভালোলাগাগুলো চিনতে পারছি। তবে এটাও ঠিক যে মার সাথে কাটানো সেই আনন্দের মুহুর্তগুলোর আলোড়ন আমাকে আাজও তীব্রভাবে টানে।
আর এই টানেই এখন যখন মনে হলো ফিরে যাই সেই সময়ে, দেখলাম পড়াশুনার চাপ, ইউটিউবে অন্যান্য ভিডিও আপলোড করার তাড়া আর ঘাড়ের উপর ও'লেভেল নামক এক বিভীষিকার বসবাস!... সন্ধ্যাবেলা মার সাথে বসে একসঙ্গে গান শোনাতো দূরের থাক, রাতের বেলা মাকে গান শোনানোর সময় পর্যন্ত হয়না আমার।
এখন যখন সেই সময় ফিরে যেতে চাইলাম, বুঝতে পারলাম এই এতো সব কাজের ভীড়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সেই জয়িতা! সেই ছোট্ট জয়িতা!
এই ভিডিওটি করতে গিয়ে মনে হলো যেনো এক মূহুর্তের জন্য সেই সময়ে ফিরে গেলাম। এক মূহুর্তের জন্য সেই ছোট্ট জয়িতার আবেগগুলও আবার অনুভব করলাম!
https://youtu.be/9IB-C0র্যমহক
জয়িতা মৈত্রী, ক্লাস টেন
Comments